নাজমুল হুদা, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি :
সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন করে আলোচনায় এসেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি।গত জুলাই—গণঅভ্যুত্থান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে—৮ আগস্ট এক প্রশাসনিক আদেশে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম অবাধেই চলছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের সংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ছাত্রদল তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি, খেলাধুলার আয়োজন এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব উদ্যোগের ফলে ছাত্রদলের প্রতি নিরপেক্ষ শিক্ষার্থীদেরও কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে ছাত্রদল নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, “আমরা কোনো বৈষম্য চািি না, বরং শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণের কথা ভেবেই কাজ করছি।”
এক শিক্ষার্থী বলেন, “ছাত্রদল এখন শুধু রাজনৈতিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ নেই। তারা নানা সামাজিক কাজ করছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভালো প্রভাব ফেলছে।”
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও ক্যাম্পাসে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি সংগঠনটি তাদের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি দুই দিনব্যাপী এক প্রকাশনা উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে আসে। এই আয়োজনে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বলেন, “শিবিরের কর্মসূচিগুলো সাধারণত খুব সরাসরি দেখা যায় না, তবে যারা সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত, তারা ভালোভাবেই জানে যে কার্যক্রম চলছে।”
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী শিক্ষক ও কর্মকর্তারা কোনো ধরনের রাজনীতিতে জড়াতে পারবে না। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন কোনো সুনির্দিষ্ট বিধিনিষেধ নেই।”
৮ আগস্টের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “সেটি গত ভিসির আমলে নেওয়া একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল, যা সিন্ডিকেটে তোলা হয়নি। আমার সময়ে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কোনো প্রক্রিয়া চলেনি। তাই, বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালানোর ক্ষেত্রে কোনো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা নেই।”
অন্যদিকে, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ভিন্নমত দেখা যাচ্ছে। একদল মনে করছে, রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক কর্মসূচি ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম ক্যাম্পাসের একাডেমিক পরিবেশকে ব্যাহত করতে পারে।
এক শিক্ষার্থী বলেন, “রাজনীতি যদি শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজে লাগে, তবে এটি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশাসনের অস্পষ্ট অবস্থান থেকে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “ছাত্ররাজনীতি যদি প্রকৃত অর্থে ছাত্রদের অধিকার রক্ষায় কাজ করত, তাহলে এটিকে স্বাগত জানানো হতো। কিন্তু বর্তমানে এটি অনেক সময় রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস বরাবরই আলো-অন্ধকারের মিশ্র চিত্র বহন করে। একদিকে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে ছাত্রদের সক্রিয় ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লিখার মতো। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্ররাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, এবং শিক্ষাঙ্গনের স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত করার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের অস্পষ্ট অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে, শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করা জরুরি হয়ে পড়েছে।