মোঃ গোলজার হোসেন ক্রাইম রিপোর্টার ঢাকা বাংলাদেশ।
নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের তালিকা করার খবরে আবার চাপে পড়তে যাচ্ছে এ সংগঠনের সদস্যরা। যারা গোপনে চলাফেরা এবং নানা মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছিলেন তাদের কাছে বিষয়টি নতুন উদ্বেগ ও ভয়ের হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নিষিদ্ধ এ সংগঠনের কর্মীদের তালিকা তৈরির জন্য সারাদেশের থানায় থানায় নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে এ নির্দেশনা বেশীরভাগ থানাতেই পেৌছে গেছে বলে জানা গেছে। একটি সূত্র জানায়, এ নির্দেশনায় পাঁচটি বিষয়ে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।
দেশের সব থানায় পাঠানো ওই নির্দেশনায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর (যদি থাকে), রাজনৈতিক পরিচয় ও সংগঠনে অবস্থান, অতীত ও বর্তমান কার্যক্রমের বিবরণ, জিডি বা মামলা থাকলে তার তথ্য জরুরি ভিত্তিতে দিতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের বরাত দিয়ে একটি সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, সামাজিক কার্যক্রম এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বুঝতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, নিষিদ্ধ সব সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিষয়েই খোঁজ নেয়া হচ্ছে বলে জানায় সূত্রটি।
ছাত্র জনতার আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৫ আগস্ট আয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে।
গত বছরের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। তবে নিষিদ্ধ হলেও অনেক নেতাকর্মী নানা শেল্টারে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছিল। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতেও দেখা যাচ্ছিল অনেককে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তের পর আবার চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগের জন্ম ও অতীত ইতিহাস
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠার সময় ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পরিবর্তে হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় একঝাঁক সূর্যবিজয়ী স্বাধীনতাপ্রেমী তারুণ্যের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়া মহাদেশের ‘বৃহত্তম’ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে ছাত্রলীগের জন্ম।
প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জল ভূমিকা ছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ । শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন, যাতে ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড ছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভূমিকাও ছিল অগ্রণী । তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে, তোলে যা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবেনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এছাড়া ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগের গেৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের
তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ-সহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে।
জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ ও যুক্ত করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপর নব্বুইয়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
যেসব কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে সরকার
গত বছরের ২৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল। তার আগেই তাদের দাবি পূরণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে যা ছিল
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ রাজনৈতিক শাখা-২ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করিয়া বিগত ১৫ বৎসরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এতৎ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হইয়াছে; এবং যেহেতু ১৫ জুলাই ২০২৪ তারিখ হইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উন্মত্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করিয়া শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করিয়াছে এবং আরও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করিয়াছে; এবং যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রহিয়াছে যে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে; সেহেতু সরকার ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা-১৮ এর উপধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল এবং উক্ত আইনের তফসিল-২ এ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামীয় ছাত্র সংগঠনকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করিল।’ এ প্রজ্ঞাপন অবিলম্বে কার্যকর করা হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।