মো,সহিদ মিয়া
৩৬ জুলাই ২০২৪ খ্রি. সেই বিভীষিকাময় দিনগুলি হৃদয়ে বারবার স্পর্শ করে, আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইসমাইল রাব্বি, জাকির, আরিফ, হুমায়ুন, রাফি, সহ অগণিত সেই তাজা প্রাণগুলির বিনিময়ে আমরা সক্ষম হয়েছিলাম ফ্যাসিস্ট সরকারকে তাড়িয়ে দিতে।
৩ আগস্ট ২০২৪ খ্রি, শনিবার রাত ১০টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে দেখে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ি, লিখেছি অনেক কথা কখনো কখনো এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে চোখের জল অবলীলায় গড়িয়ে পড়েছিলো।
হৃদয় দেউলিয়া হয়ে গেছে রাত পোহালে নিজ জেলা সুনামগঞ্জ শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিব এবং সেখানে ছাত্র জনতার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করব,ফেসবুকে অনেক কথা স্ট্যাটাস দিয়েছি, সকাল হলো লাল একটি পাঞ্জাবি পরে না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম আল্লাহর নামে এবং পিছন দিয়েও তাকাচ্ছি বার বার হয়তো আর ফিরে আসবো না,
হাতে রয়েছে একটি ব্যাগ (সচরাচর যে ব্যাগ টি হাতে থাকে আমার)
পৌছালাম স্থানীয় বাজার জয়নগরে, তখন বাজে সাড়ে আটটা এদিক সেদিক থাকাই লক্ষ্য করছি কাউকে সাথে পাই কি না। কাউকে না পেয়ে নিজের ব্যবসা কেন্দ্রে এসে দোকানের কর্মচারীদেরকে বলে রওনা দিলাম জেলা শহর সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। এর পূর্বে রাত্রিবেলায় ইসলামগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আবু সাঈদ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছিলো,
কথা হয়েছিলো শাহিনা চৌধুরীর রুবির সাথে,রহমান তৈয়ব গিলমান হোসেন সহ শহরকেন্দ্রিক বাসিন্দার অনেক জনের সাথে যে, দশটার ভিতরেই আপনাদের কাছে পৌঁছাব এবং যুদ্ধে নামবো আমার ছাত্র জনতার পক্ষে। সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে যখন আমি গাড়িতে তখন মইনুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান স্যার আমাকে ফোন দেন এবং বলেন কিছু ছেলেরা আমাদের কলেজ থেকে একটি মিছিল বের করবে, এতে আমাদের বাধা দেওয়া দরকার। সরকারিভাবে নির্দেশ আসছে আমি বলেছি এগুলো আপনি বাধা দিবেন না কারণ পরবর্তীতে আপনার সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিছুক্ষণ পর জয়নগর বাজার হাজীগঞ্জ বক্স উচ্চ বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক লিলু মিয়া স্যার আমাকে ফোন দেন এবং একইভাবে বলেন আমাদের স্কুল থেকে একটি দল ছাত্র জনতার পক্ষে মিছিল দিবে। যেহেতু আপনি অভিভাবক সদস্য সেই হিসাবে নিষেধ করা আমাদের প্রয়োজন কি না! আমি তখন বলেছি স্যার আপনি মোবাইল বন্ধ রাখেন আর এ ব্যাপারে কোন কথা বলবেন না। দেশ এখন এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়াচ্ছে আপনি যে দিকে যাবেন সেদিক যদি পরাজিত হয় তখন আপনার সমস্যা হতে পারে। মোবাইলে আলোচনা করতে করতে পৌছালাম সুনামগঞ্জ জেলা শহরে।এরই মধ্যে ওয়েজ খালি যেতে না যেতে পুলিশ বাহিনীরা আমাদেরকে বাধা দেয় এবং চেক করার আবির্ভাব, আমরা যারা যাত্রী ছিলাম সবাই ঐক্যমতের ভিত্তিতে তেজশ্রী কন্ঠে বলছি আপনারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন! আমরা শহরে যাচ্ছি আমাদের প্রয়োজনে। আপনাদের বাধা দেওয়ার অধিকার কে
দিয়েছে?
তখন তারা আমাদেরকে ছেড়ে দেয়। নতুন কৌটের সামনে পৌঁছাতেই সিএনজি গাড়িটি আর যাচ্ছে না, আমরা সবাই নেমে পড়লাম। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি ট্রাফিক পয়েন্টের শহীদ মিনারের কাছে। সেখানে দেখছি কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী শহীদ মিনারে জড়ো হচ্ছেন। আমি একটু এগিয়ে গেলাম পৌর বিপণিতে। সেখানে আমাদের রুবি আপা, সাঈদ ভাই, তৈয়বুর রহমান সহ অন্যান্যরা অপেক্ষা করছেন। আমরা একসাথে মিছিলে জড়ো হবো। তখন সময় প্রায় দশটা বিশ মিনিট বাজে। হঠাৎ শুনি হই-হই একটি শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে দেখার জন্য শহীদ মিনারে ছুটে আসি। কিন্তু আসতে আসতে এলোমেলো হয়ে গেল সব সুযোগ,মিললো না ঝগড়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘক্ষণ!
ছাত্র-জনতাকে সনাক্ত করা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসররা, মারার জন্য হামলা দিয়েছিলো, আমি তখন নির্বাক,যারা আমার সাথে থাকার কথা তারা কেউ আমার সাথে নেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের সেই পা-চাটা গোলামরা। হাতে দেশীয় অস্ত্র যেমন, রামদা, কোরাল, দা কাছি,হকিস্টিক,রড,পিস্তল, টেন গান, বন্দুকসহ, লক্ষী, বৈঠা, বিভিন্ন প্রকারের অস্ত্র।
যা সাধারণ মানুষকে অবাক করে ফেললো। প্রায় ১৫-২০ মিনিটের ভিতরে মোটামুটি ৫০০ থেকে ৭০০ জন আওয়ামী লীগের, নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে গেলেন এবং দখল করে নিলেন ট্রাফিক পয়েন্টের পুরো এলাকা সবগুলো দোকানপাট মূহুর্ত্তের মধ্যে বন্ধ করে দিল মালিকপক্ষ। সাধারণ জনতারা নিরবে নিভৃতে নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করতে শুরু করলো। আমি এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছি, আমাদের ছাত্র জনতা কোথায় রয়েছে কিন্তু তাদেরকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখতে পেলাম একটি মিছিল কোড পয়েন্ট থেকে উত্তর প্রান্তে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসতেছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ পন্থী যারা ছিল তারা দক্ষিণ দিকে ধর-ধর বলে এগুচ্ছে, ইট পাটকেল ছুড়ছে। আমি আমার হাতের মোবাইল নিয়ে ভিডিও করতে লাগলাম এবং ছাত্রদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু একপর্যায়ে সাহস হারিয়ে ফেলি, কয়েকটি ইটের কংক্রিট আমার উপরে পড়ছে। আওয়ামীলীগরা মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ মিনিট ইট পাটকেল মারতে লাগলো। সেখানে আওয়ামীলীগ পক্ষের একজন আহত হলো। পুলিশ আসলো ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া করতে লাগলো। যে যেভাবে পারলো আত্মরক্ষা করলো। পুলিশরা আওয়ামীলীগের যারা ছিলেন তাদের পক্ষ নিলো। স্লোগান দিচ্ছেন “আর করিস না বে বে এক দফারে কবর দে”। এসব দেখতে দেখতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।
এর মধ্যে কয়েক দফা ইট পাকটেল দিয়ে সংঘর্ষ হলো। একপর্যায়ে কোর্টের সামনে এলাম। কয়েকজন আইনজীবীকে পেলাম, তারমধ্যে এডভোকেট আমিরুল হকের সাক্ষাৎকার নিতে চাচ্ছিলাম কিন্তু এমন এক পরিবেশে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তখন কোর্টের ভিতর পুনরায় আওয়ামীলীগ ছাত্র জনতাকে ধাওয়া দেয়। তখন ছাত্র জনতা কোর্টের ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তখন এডভোকেট আমিরুল ভাইয়ের সাক্ষাৎ পাই এবং সাক্ষাৎকারে তিনি অবলীলায় বলছিলেন “আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা না করে ঘরে ফিরবো না, আমাদের অধিকার এবং এই ফ্যাসিস্ট খুনি হাসিনাকে পদত্যাগ করিয়ে আইনের আওতায় এনে সেই আবু সাঈদ মুগ্ধর মত হাজার ছাত্র জনতাকে খুনের দায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাবো ইনশাআল্লাহ এই আমাদের প্রত্যাশা” লাইভ শেষ করতে না করতে শুনতে পেলাম, ছাত্র জনতার পক্ষের এক ব্যক্তিকে পুলিশ গুলি করেছে কোর্টের এলাকায়। আহত ব্যক্তিকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। শহর তখন নীরব…
হতভাগার মত ফিরলাম নিজ বাজারের উদ্দেশ্যে, কাঠইরের মোড়ে একটি রেস্টুরেন্টে এসে ভাত খেলাম। অনেকজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে পেলাম পাশা-পাশি সেইসঙ্গে পেলাম ছাত্র জনতার পক্ষেরও অনেকজনকে।
আসার সময় আমার হাতের স্মার্ট ফোণটি হারিয়ে যায় শাখাইতি এলাকায়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস নিরুপায় হয়ে দোকানে ফিরে আসি এবং ভাবি এখন কি করা যায়! দেশের যে পরিবেশ পরিস্থিতি আমি কিভাবে সংগ্রহ করবো খবর!! এদিকে ঢাকার কেন্দ্রীয় স্থান থেকে ছাত্র সমন্বয়কগণ বেলা ৩:০০ টায় সংবাদ সম্মেলন করে সোমবারের ঢাকা মুখি লং মার্চ স্থগিত করেন। এদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের মন্ত্রিসভার বৈঠক বসছে। বেলা চারটায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন তারা যেহেতু ৬ তারিখে মঙ্গলবার ঢাকা মুখে লংমার্চ দেবে তবে আপনারা আগামীকাল বেলা ১১ পর থেকে মাঠে থাকবেন। সকল সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরাও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
যথারীতি প্রজ্ঞাপন জারি হলো। সন্ধ্যা ছয়টায় এই ঘোষণাকে ছাত্র জনতার সমন্বয়কগণ আবার পাল্টা ঘোষণা দিলেন,আগামীকাল সোমবার ভোর পাঁচটা থেকে ঢাকা মুখি লং মার্চ এবং গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি। চলছে ছাত্র-জনতার গভীর জল্পনা -কল্পনা,সংগ্রাম। তখন বাংলার সকল মানুষ এক দাবিতেই রূপান্তর হয়ে গেল”শেখ হাসিনা গদি ছাড়” আর উপায় নেই।
ওই রাতে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে যায়, কিন্তু ওই রাতে, পীর ফজলুর করীম চরমোনাই সাহেব বীরত্বের পরিচয় দেন। সেই রাতে বরিশাল জেলায় ১১ টায় বড় বড় লঞ্চে ১৫০০০ হাজার ছাত্র জনতার নিয়ে সোমবার ভোর বেলায় সদরঘাটে আসেন এবং ফজরের নামাজ পড়ে, নারায়ে তকবির জয়ধ্বনি দিয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন। তখন সে সময় ছিল সারা ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি।
সেই জারি ভঙ্গ করলেন ফজলুল করিম সাহেব ও তার অনুসারীরা। পুলিশরা তখন নির্বিচারে গুলি করে। শুধু ফজলুল করিম সাহেবের অনুসারীদের মধ্যে সরাসরি ৭জনকে নিহত করে তবুও তারা এক কদমও পিছে সরে আসেননি। পুলিশরা তখন কুকুরের মতো পাগলপারা হয়ে গেছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ারাও তৎপর। সারা ঢাকা থম-থমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সকাল সাতটা বাজে,ছাত্র জনতা তখন ঢাকার অলি গলির কানায় কানায় ভর্তি গণভবন ঘেরাও করবে। ছাত্র-জনতা কেউ বুঝে কেউ না বুঝে কেউ আবার উৎসাহ উদ্দীপনায় গণভবনের দিকে রওয়ানা করলেন, যেমন যাত্রাবাড়ী, জিনজিরা, মতিঝিল,মিরপুর,আগ্রাবাদ, গুলিস্তান, মোহাম্মদপুর, লালবাগ,ফকিরা ফুল সহ প্রতিটা রুটে মানুষ ছুটছে পঙ্গপালের মতো।
তবে চোখে পারার মতো জনতা ছিলেন গার্মেন্টসের শ্রমিকগণ। কারণ সেদিন যখন গার্মেন্টসের শ্রমিকগণ গিয়ে দেখে গার্মেন্টস বন্ধ তখন তারা গণভবনের দিকে রওনা দেন। বেলা ১১টায় সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামান শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। তখন তিনি ফোন ধরেন না, এ-র পরে হাসিনার পিএস কে ফোন দেন এবং তাকে অবগত করেন দেশের পরিবেশ ভালো না। আপনার নেত্রীকে বলেন এইদিকে নজর দিতে। এর পরে ১২টায় আবার সেনাপ্রধান শেখ হাসিনাকে ফোন দেন এবং প্রায় ১৫ মিনিট কথা হয় তখন শেখ হাসিনা দেশ থেকে যাবেন না এই বলে রাগাম্বিত হয়ে মোবাইল কেটে দেন। তখন সেনাপ্রধান ওয়াকারুজ্জামান সরাসরি ১০ মিনিটের ভিতর গণবভনে প্রবেশ করেন এবং শেখ হাসিনাকে বলেন,আপনাকে আমার পক্ষে আর সেইভ করা সম্ভব হবে না। তখন শেখ হাসিনা বলেন, তোমাদের জন্য আমি কি কি না করলাম আর কি করতে হবে এখন যতজন মারতে হয় মেরে ফেলেন তবুও আমি এই দেশ ছাড়বো না। তখন ওয়াকারউজ্জামান শেখ রেহানা কে সামনে নিয়ে আসেন এবং তার সাথে কথা বলতে বলেন। শেখ রেহেনাও বুঝাতে পারলেন না। তখন ইলেকট্রনিক্স প্রজেক্টর এর দিকে তাকান সেখানে দেখা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ জনতা বঙ্গভবনের দিকে অমুখ হয়ে পঙ্গপালের মতো ছুটছে। তখন আবার জয়ের সাথে কথা বলেন জনাব ওয়াকারুজ্জামান, তখন জয় তার মা শেখ হাসিনাকে বলেন এবং বুঝান তখন তিনি বাধ্য হন দেশ ছাড়তে। এরপরে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয় আসবাবপত্র গুছানোর জন্য।পরিশেষে শেখ হাসিনা পাঁচ মিনিটের ভাষণ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু সেই সুযোগটাও তাকে দেওয়া হয়নি। যদি এই সুযোগ দেওয়া হতো আর যেভাবে ছাত্র জনতা দখল করছিল হয়তো তার তখন এখানেই নিঃশেষ হওয়ার জন্য সম্ভাবনা ছিলো। এমন চিত্র শুধু আমি সুনামগঞ্জ থেকে দেখিনি দেখেছেন প্রতিটি জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সারা বাংলার জাগ্রত জনতা। এমন ইতিহাস আমার সোনার বাংলায় আর যেন না হয় সেই কামনা করি।